অন্ধকার জগতের বাদশা দাউদ ইব্রাহিম
ডনের জন্য এগারো মুলুকের পুলিশ অপেক্ষা করে। তবু তাঁকে ধরতে পারা শুধু কঠিনই নয় অবাস্তব। সিনেমার এমন অতিনাটকীয় সংলাপকে যিনি বাস্তব জীবনে অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়েছেন, তিনি ডন দাউদ ইব্রাহিম। অন্ধকার জগতের বাদশা। তাঁর কাছে ফেল বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থা, ইন্টেলিজেন্স ডিপারর্টমেন্টও। এমনই তাঁর দাপট। তিনি পারেন না, অপরাধজগতে এমন কাজ নেই। খুন, জখম, রাহাজানি, ড্রাগ পাচার, স্মাগলিং থেকে সন্ত্রাসমূলক কাজ। তাঁর সুদক্ষ হাত পড়েনি কোনখানে? ৮০ ও ৯০ দশকের মাঝামাঝি একাধিক জঙ্গিহামলার ঘটনায় বীরত্বের সঙ্গে নাম জড়িয়েছেন এই আন্ডারওয়ার্ল্ড বাদশা।
সম্প্রতি খবর মিলেছে সেই ডন নাকি হাসপাতালে ভর্তি। করাচির হাসপাতালে গুরুতর পাহারায় রয়েছেন দাউদ। হাসপাতালের একটি তলা পুরো ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে তার জন্য। নিকটাত্মীয় ও বিশ্বস্ত সাঙ্গপাঙ্গ ছাড়া কারও প্রবেশ নেই হাসপাতালের ওই জায়গাটিতে। এ-ও শোনা যাচ্ছে, দাউদের উপর নাকি বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে। সেই হামলার নেপথ্যে কে বা সত্যিই তেমন কিছু ঘটেছে কিনা, সে সম্পর্কে এখনও প্রামাণ্য তথ্য নেই।
আরও পড়ুন: দাউদ ইব্রাহিমকে বিষপ্রয়োগ! গুরুতর অবস্থায় কেন হাসপাতালে ভর্তি ডন?
দাউদ এবং তাঁর ডি-গ্যাং নিয়ে এমন রটনা কম হয়নি। এর আগেও একাধিক বার বিভিন্ন জল্পনা ছড়িয়েছে, ছড়িয়েছে বিতর্কও। তার কতখানি সত্য, কতখানি রটনা, বলা মুশকিল। তবে ওই যে, যাহা রটে, তাহার কিছু তো ঘটে। সেই তত্ত্ব মিলিয়ে ডন দাউদকে নিয়ে কিংবদন্তীও কম নেই। আসুন, জেনে নেওয়া যাক, এমন দাউদের সম্পর্কে এমন কিছু ঘটনা, যা সত্যি হলেও গল্প।
কোণঠাসা দাউদ
যে অপরাধ জগতের ভাষায় পোক্ত যে দাউদ, তার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? কেমন ছিলেন স্কুলজীবনে দাউদ। তখন থেকেই কি উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর ডন-সত্তা। দাউদের এক গুরু জাইদি অবশ্য একটি বইয়ে লিখেছেন, যে দাউদ ও তাঁর ভাই সাবির ইব্রাহিম নাকি স্কুল জীবনে ছিলেন দুর্বলদের দলে। ছোটবেলায় স্কুলে নাকি দেদার বুলিও করা হত দাউদকে। আহমেদ সেলর হাই স্কুলে পড়াকালীন রোড সেফটি পেট্রোল (RSP)-র দায়িত্ব পেয়েছিলেন দাউদ। নাগপড়া জংশনে কাজের দায়িত্ব ছিল তাঁর। সেখানেই একবার ডিউটি দিতে দিতে দাউদ জানতে পারেন, স্কুলে বাস্কেটবল টিমের অন্যান্যরা তাঁর দাদাকে ধরে মারছেন। দায়দায়িত্ব সব ফেলে ভাইকে বাঁচাতে ছোটেন। কিন্তু অতগুলোকে ছেলের সঙ্গে একা লড়ার ক্ষমতা তখনও দাউদের ছিল না। দাদার সঙ্গে বেধড়ক মার খান দাউদও।
গুরু-শিষ্য় সংবাদ
জানা যায়, দাউদের এই অপরাধ জগতের দ্রোণাচার্য ছিলেন খলিদ খান পেচা নামে এক ব্যক্তি। পাঠান খলিদ ভোপাল থেকে মুম্বইয়ে এসেছিলেন পুলিশ হতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গিয়ে পড়েন অন্ধকার জগতে। অনেকেই বলেন, দাউদের দাউদ হওয়া হত না যদি না খলিদ থাকতেন। জাইদি জানান, দাউদের ডি-গ্যাংয়ের সূত্রপাতও কিন্তু খলিদের হাত ধরেই। আশির দশকে মুম্বইয়ে বিশাল অপরাধের সিন্ডিকেট ছিল এই ডি-গ্যাং। সেই খলিদের কাছ থেকেই অপরাধ জগতের ভাষা যাবতীয় শিখেছিলেন দাউদ। অপরাধের দুনিয়ায় টিকে থাকার মন্ত্র, সারভাইভাল টেকনিক সবই হাতে ধরে দাউদকে শিখিয়েছেন তিনি। দাউদ যখন নতুন, সে সময় খলিদই তাঁকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে নিরস্ত্র হয়েও শত্রুকে পরাস্ত করতে হয়। দাউদ তাকে বলতেন হিরো ফাইট। খলিদ ছিলেন দাউদের কাছে নিজের দাদার মতো। যে দাউদের জন্য বুক পেতে গুলিও খেতে পারতেন। একবার দাউদ ও সাবিরের উপরে নাগপাড়া থানায় হামলা চালায় দুই পাঠান। যে গুলিতে আদতে নাম লেখা ছিল দাউদের, তা ছুটে এসে বুকে নেন খলিদ। সেই প্রথম নয়। একাধিক বার বুদ্ধিমত্তা ও তাৎক্ষণিক ক্ষীপ্রতা দিয়ে দাউদকে বাঁচিয়েছেন তিনি।
গুরুর গুরু
শুধু খলিদই নয়। খলিদের আগেও দাউদের আরও এক গুরু ছিলেন। তাঁর নাম ছিল জেনাবাই। জেনাবাই আদতে ছিল দাউদের মা আমিনার বান্ধবী। বম্বে ক্রাইম ব্রাঞ্চের খোচর ছিলেন তিনি। খলিদের আগে থেকেই দাউদের মগজধোলাই হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল জেনাবাইয়ের হাতে। ছোটো থেকে অনেকটা সময় তিনি কাটাতেন জেনাবাইয়ের সঙ্গে। নানা গল্পগাছা শুনতেন অপরাধ জগতের। কবে যে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করলেন দাউদ, তা বোধহয় নিজেও জানতে পারলেন না।
১৯-এ হাতেখড়ি
স্কুলের মারখাওয়া ছেলেটা প্রথম বড় অপরাধ করে ফেলল মাত্র ১৯-এই। ১৯৭৪ সালে একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনায় জড়িত ছিল দাউদ। যদিও দাউদ ভেবেছিলেন, এক দাগী মস্তানের টাকা লুট করছেন তিনি, তবে পরে দেখা যায় সেই টাকাটি একটি মেট্রোপলিটন ব্যাঙ্কের।
দাউদ ও ছোটা শাকিল
একদিন খলিদের হাতে অপরাধের পাঠ শিখেছিলেন যে দাউদ, সেই দাউদ আবার অচিরেই হয়ে উঠছিলেন ছোটা শাকিলের গুরুদেব। দাউদের বি-টিম অন্যতম সদস্য ছিল এই ছোটা শাকিল। খুন, সন্ত্রাস, লুঠপাটের মতো একাধিক দাগী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সে। ১৯৯৩ সালে মুম্বই বিস্ফোরণের ঘটনাতেও জডিয়ে ছিল দাউদের শিষ্য।
আরও পড়ুন: আঙুলে গ্যাংগ্রিন নিয়েই দ্বিতীয় বিয়ে! মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের জীবনে এবার কোন নতুন মোড়?
স্কুলজীবনে কোণঠাসা দাউদ, দাদাকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেয়ে ফিরে আসা দাউদ ক্রমে হয়ে উঠলেন গোটা বিশ্বের ত্রাস। সেই ডন, যার তল পাওয়া কঠিন, যাকে আজ পর্যন্ত হাতের নাগালে পায়নি পৃথিবীর কোনও পুলিশ। যে সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যান দর্শক, একেকটা দৃশ্যে মুহুর্মুহু সিটি পড়ে, সেই রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে উঠেছেন ক্রমে দাউদ। হোক না সে অপরাধ জগতের বাসিন্দা, তবে সেই অন্ধকার পেশাতেও যে তিনি সেরার সেরা, তা গোটা জীবন ধরে প্রমাণ করে এসেছেন দাউদ ইব্রাহিম।